চতুরঙ্গ
Image - Chaturanga ( Symbolic ) |
‘আমি যে প্রতিটি নিঃশ্বাসে ভালোবেসেছি এই নতুন জীবনের পরের
জীবন দ্বিগুণভাবে বাঁচব ।’
-
কিশোয়ার নাহিদ
নারীর মোহিনী অবয়বের ওপর যে মঞ্চসাজের আলো এসে পরেছে , তা
মূলত ছদ্মবেশী । কিন্তু দামিনী চরিত্রের আলো আরোপিত নয় , অন্ধকারের হৃদয় থেকে
উৎসারিত আলো । ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসটি যেন অখণ্ড জীবনরূপের চারটি অঁঙ্গের কাহিনী ।
উপন্যাসে দামিনী চরিত্রটির জীবনসত্য অন্বেষণের প্রচেষ্টা , এক নতুন আঙ্গিকে দেখা
গিয়েছে ।
‘যেন এক পশলা বৃষ্টি , যেন দেয়ালের পাশের অদৃশ্য লোক হইতে
ফুলের ছিন্ন পাপড়ির মতো জীবনের ছোট ছোট পরিচয় স্পর্শ করিয়া যাইত ।’
‘দামিনী’ নামের অর্থ ‘বিদ্যুৎ চমক’ । তার নামের সঙ্গেঁ তার
চরিত্রটিও শানিত উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে উপন্যাসে । প্রথম থেকে সে যেন প্রতিবাদী ,
বিদ্রোহিনী । অন্নদাপ্রসাদ দামিনীর সাথে বিয়ে দেন শিবতোষের , কিন্তু সংসার বিরাগী
শিবতোষের সন্ন্যাসী জীবন গ্রহন করলেও দামিনী তা কখনোই মেনে নেয়নি । তাই মৃত্যুর
পূর্বে শিবতোষ দামিনীর কামনা বাসনার মোহ ত্যাগের জন্য লীলানন্দ স্বামীর কাছে
সমর্পন করে যায় । এরপর থেকেই বেপড়োয়া দামিনী অধিকারহীনতার অভিমানে আরও ক্ষুব্ধ ও
ব্যাক্তিত্বময়ী হয়ে ওঠে –
‘দামিনীর মধ্যে নারীর আর এক বিশ্বরূপ দেখিয়াছি , সে নারী
মৃত্যুর কেহ নয় , সে জীবনরসের রসিক । ... সে কিছুই ফেলিতে চায় না , সে সন্ন্যাসীকে
ঘরে স্থান দিতে নারাজ’ ;
দামিনী বৈরাগ্যকে কখনো স্বীকার করে নি সে জীবনকে পুরোপুরি
ভোগ করতে চেয়েছে , অপরদিকে উপন্যাসে আর এক নারী চরিত্রের সন্ধান পাই , ননীবালা ।
তার চরিত্রটি দামিনীর একেবারে বিপরীত মূখী । সে জীবন থেকে মৃত্যুর পথকে বেছে
নিয়েছে । -
“... অপবিত্রের কলঙ্ক যে নারী আপনাতে গ্রহণ করিল ,পাপিষ্টের
জন্য যে নারী জীবন দিয়া ফেলিল , সে নারী মরিয়া জীবনের সুধাপাত্র পূণর্তর করিল ।”
Symbolic image - Damini |
তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও দামিনী প্রবল
ব্যাক্তিত্ব ও স্বাভাবিক মনোবৃত্তি নিয়ে উপস্থাপিত হয়েছে । ‘দামিনী যেন
শ্রাবনমেঘের ভেতরকার দামিনী ।’ তার সাজ-পোশাকে , বৈধ্যব্যের লক্ষণ ছিল না । সে
অনায়াসে গুরুজিকে অবজ্ঞা করেছে , আধুনিক লেখকের বই পড়েছে , নতুন করে বাঁচার তথা
জীবনকে আরো দৃঢ়ভাবে বাঁচতে চেয়েছে শচীশকে আঁকড়ে ধরে , সে শান্ত হয়ে উঠেছে কিন্তু এ
চেষ্টায় ব্যার্থ হয়ে তার পুঞ্জিত যৌবন হয়ে উঠেছে সর্বগ্রাসী আদিম জন্তু । অন্ধকার
গুহায় তার যৌবনক্ষুধা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরেছে শচীশের ওপর ।
এরপরেই দেখা যায় অকুণ্ঠিত তেজে শ্রীবিলাসকে খুটি করে শচীশের
মনে ঈর্ষা জাগাবার চেষ্টা করেছে । শ্রীবিলাশের সাথে দামিনী সহজভাবে মনের কথা বলে
যা শচীশের সহ্য হয় না , যাতে দামিনীর আত্মতৃপ্তি ঘটে এবং তার “চোখ দিয়া বিদ্যুৎ
ঠিকরাইয়া পড়িল – সে মনে মনে কঠিন হাসি হাসিল ।”
পরবর্তীতে বিভ্রান্ত শচীশ আত্মসংবরণের জন্য দামিনীকে আশ্রয়
ছেড়ে চলে যেতে বললে , প্রতিবাদী দামিনী তীব্র ঝংকারে বলে উঠে – “... আমি কি
তোমাদের দশ-পচিঁশের ঘুঁটি ? ... আমাকে তোমাদের ভালো লাগিতেছে না বলিয়া তোমাদের
ইচ্ছায় আমি নড়িব না ।”
এমনকি আশ্রমের বাতাবরণ বজায় রাখার জন্য লীলানন্দ স্বামী
তাকে তার মাসির কাছে রেখে আসতে চাইলে , আত্মসন্মান সম্পন্ন দামিনী দৃঢ় স্বরে বলেছে
–
“... আমার ভার বেশি ; সে ভার আপনি সাধ করিয়া লইয়াছেন ; এ
আপনি অন্যের ঘাড়ে নামাইতে পারিবেন না ।”
তবে একমাত্র শচীশের শিষ্যত্ব স্বীকার করা ছাড়া আর কারো কাছে
সে ঘুঁটি হতে চায় নি । দামিনী শুধুমাত্র শচীশকে গুরু হিসেবে পেতে চেয়েছে এবং শচীশ
তা মেনে নেওয়ার পর –
“ দামিনীর যে অসহ্য দীপ্তি ছিল তার আলোটুকু রহিল , তাপ রহিল
না ।”
শচীশের সাথে মানসিক দূরত্ব অনুযায়ী স্বামীজির সঙ্গে দামিনীর
সম্পর্কের হেরফের হয়েছে । এরপর নবীনের স্ত্রী আত্মহত্যা করলে তারা তিনজন সেই আশ্রম
থেকে বেড়িয়ে আসে । এরপরই ঘটনাচক্রে দামিনী সমাজকে অগ্রাহ্য করে , বৈধব্যকে তুচ্ছ
করে শ্রীবিলাসকে বিয়ে করে । এখানেই দামিনী অন্যান্য চরিত্র থেকে স্বতন্ত্র হয়ে
উঠেছে ।
উপসংহারঃ পূর্বযুগের সমাজ থেকে আধুনিক সমাজে নারীর অবস্থান
যে কত বিচিত্র সংকটের সম্মুখীন হয় এবং তার পরীক্ষাগার হয়ে উঠেছে চতুরঙ্গ উপন্যাসটি
। সমাজের অচলায়তনকে একা দৃঢ় ব্যাক্তিত্বের সাথে ভেঙ্গে দামিনী বেড়িয়ে এসেছে শনিত
উজ্জ্বল হয়ে । এখানেই চরিত্রটির সার্থকতা ।
If you liked our effort please like our facebook page - https://www.facebook.com/bengaliliterature4you/
Soon we will upload our youtube channel. Connected with us .
No comments:
Post a Comment